অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাত মাস আগে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গাজীপুর সিটি করপোরেশনে (গাসিক) অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করে নিরপেক্ষতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটগ্রহণ নিয়ে কোনো প্রার্থীই নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেননি। এমনকি কোনো রাজনৈতিক দল বা নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও কোনো অভিযোগ আসেনি। এটা বর্তমান ইসির জন্য বিশাল অর্জন। তাই ইসি মনে করছে গাসিক নির্বাচনই হবে জাতীয় নির্বাচনের মডেল। সেভাবেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হচ্ছে বলে ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এদিকে ফল ঘোষণার পর মেয়র পদে পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী মেয়রকে স্বাগত জানিয়েছেন। এছাড়া বিজয়ী মেয়রও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পরাজিত মেয়র প্রার্থীকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার সহযোগিতা চেয়েছেন। যা দেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নির্বাচন কমিশনের জন্যও এ বিষয়টি ইতিবাচক। তবে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হওয়ার পরও গাসিক নির্বাচনের ফল ঘোষণায় বিলম্ব হওয়ায় এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করে নির্ভুল ভোটের হিসাবসহ ফল ঘোষণা করতে গিয়ে বিলম্ব হয়েছে।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা ছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে ইসির প্রত্যাশা ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন। তাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। কারণ ভোটগ্রহণ নিয়ে কোনো প্রার্থী, নির্বাচন পর্যবেক্ষক কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলই অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেননি। বরং সবাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসির প্রশংসা করেছে।
নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে গাসিক নির্বাচনই হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মডেল। তবে গাসিক নির্বাচনের মতো জাতীয় নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হবে না বিধায় সেখানে পরিস্থিতি কিছুটা অন্য রকম হতে পারে। কারণ অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ব্যালট সংরক্ষণে অধিকতর নিরাপত্তামূল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ভোট গণনা করতে গিয়ে কোথাও কোথাও সময় বেশি লাগতে পারে।
উল্লেখ্য, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বিএনপি ও তাদের সমমনা দলের পক্ষ থেকে বলা হয় এই ইসির পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
আর এই ইসি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই বলতে থাকে সুষ্ঠু নির্বাচন করাই তাদের চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের প্রথম পরীক্ষা দেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও ফল ঘোষণায় বিলম্বসহ ছোটখাটো কিছু ঘটনা নিয়ে ইসির বিরুদ্ধে সামান্য সমালোচনা হয়। তবে এরপর ইউপিসহ কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটায় সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি। কিন্তু জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম হওয়ায় ওই নির্বাচন স্থগিত করার পর আবারও সুষ্ঠু নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে ইসি নিজেদের ইমেজ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে আন্দোলন করতে থাকায় এবং জাতিসংঘ ও বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান জানানোর পর ইসি নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে অধিকতর সতর্ক হয়। এরই অংশ হিসেবে জাতীয় নির্বাচনসহ সকল নির্বাচন সুষ্ঠু করতে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করার প্রস্তুতি জোরদার করে।
টেস্ট কেস হিসেবে গাজীপুর সিটির নির্বাচন ॥ সুষ্ঠু করতে আগে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে ইসি। প্রায় ৪ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের মাধ্যমে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয়, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনিয়মের জন্য তাৎক্ষণিক শাস্তির ব্যবস্থা, ইভিএমে ভোট ও কেন্দ্রে কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপন থেকে শুরু করে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এমন কিছু নেই যা ইসি করেনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে বসে ইসির সকল সদস্য ও কর্মকর্তারা মনিটরিংয়ে ব্যস্ত থাকেন। সাংবাদিকদেরও ইসির সঙ্গে থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ দেন। ভোট শেষে একজন নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের জানান, গাসিক নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সকাল থেকে উৎসবমুখর পরিবেশে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি এবং ভোটে অনিয়মের কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হয়নি। তবে ধীরগতিতে ভোটগ্রহণ নিয়ে অভিযোগ ওঠার বিষয়ে জানানো হয় ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নতুন পদ্ধতি হওয়ায় বয়স্ক ভোটারদের একটু সমস্যা হয়েছে। এ কারণে ভোটগ্রহণে কিছুটা ধীরগতি ছিল। তবে যারা বিকেল ৪টার মধ্যে ভোট কেন্দ্রে গেছেন তাদের ভোট নিতে কোনো কোনো কেন্দ্রে সন্ধ্যা ৬টা বেজে গেছে। তবুও ভোটারদের ভোট দিতে দেওয়া হয়েছে।
গাসিক নির্বাচনের দিন পুরো গাজীপুর এলাকা ছিল নিরাপত্তার চাদরে ডাকা। তাই কোনো প্রকার সংঘর্ষ বা হতাহতের ঘটনা ছাড়াই এ নির্বাচন শেষ হয়। দেশের সবচেয়ে বড় সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে কোনো ধরনের গোলযোগের ঘটনা ঘটেনি। ৪৮০টি কেন্দ্রের মধ্যে সব কেন্দ্রে দিনভর শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হয়। সকল প্রার্থী স্বস্তিতে ভোট দিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হওয়ার কথা জানান। ভোটাররা নিজ নিজ কেন্দ্রে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট প্রদান করেন। ফল ঘোষণার সময়ও পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। তবে ফল দিতে দিতে বিলম্ব হওয়ায় কেউ কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। যদিও ফল ঘোষণার পর বিজয়ী ও বিজিত প্রার্থী এ নিয়ে কোনো অভিযোগ না করে তা মেনে নেন।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে ইসি। এরই অংশ হিসেবে ২৫ মে দেশের সবচেয়ে বড় অর্থাৎ প্রায় ১২ লাখ ভোটারের গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় ইসি। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। এ নির্বাচনে নির্বাচিত ৭৬ জন কাউন্সিলরের (৫৭ ওয়ার্ডে ৫৭ জন সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত ১৯ ওয়ার্ডের ১৯ জন নারী কাউন্সিলর) মধ্যে আওয়ামী লীগের ৬১ জন এবং বিএনপির ১৫ জন কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও দলটির ২৯ জন স্থানীয় নেতা কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেন।
গাসিক নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে নির্বাচন কশিনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার ছিল সবই করেছে ইসি। তাই অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে কোনো অভিযোগ আসেনি ইসির কাছে।
সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে গতবছর ৫ ফেব্রুয়ারি সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি। নিজেদের মধ্যে ৭টি বৈঠক ও দেশের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে ৪টি বৈঠকের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিগতভাবে কমিটির কাছে প্রস্তাবকৃত ৩২২ জনের মধ্য থেকে বাছাই করে সার্চ কমিটি ২৪ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নামের তালিকা হস্তান্তর করেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি সেখান থেকে ৫ জনকে নিয়ে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করেন। এর মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) নিয়োগ করা হয় সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে। আর ৪ কশিমনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবীব খান, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও সাবেক সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমানকে। ২৭ ফেব্রুয়ারি নতুন ইসি প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ করে। এই ইসি নির্বাচন ভবনে গিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে গত বছর ২৮ ফেব্রুয়ারি।
এই নির্বাচন কমিশন গঠনের পর বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবীরাও ইতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। রাজনীতিতে বিএনপির অত্যন্ত কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ইতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। নতুন ইসির প্রতি বিএনপিকে আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, নতুন সিইসি অত্যন্ত দক্ষ, মেধাবী সাহসী ও নিরপেক্ষ। কাজী হাবিবুল আউয়ালের মতো খাঁটি মানুষ পেয়েছে ইসি। তাই বিএনপি তার নেতৃত্বাধীন ইসির প্রতি আস্থা রাখতে পারে। সরকার একটা ভালো কাজ করেছে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, এই ইসিকে সবার সহযোগিতা করা উচিত। তবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই হবে এই কমিশনের বড় চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন গতবছর ২৮ ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম বৈঠকেই সুষ্ঠু নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। সে অনুসারে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। এরই অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ইসি। তবে বিএনপি ও তাদের সমমনা ক’টি দল ওই মতবিনিময় সভায় অংশ নেয়নি। এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা নির্বাচন করবে না বলে জানায়।
এর কারণ হিসেবে জানায় এই নির্বাচন কমিশন নাকি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। বিএনপির এমন অবস্থানের প্রতিক্রিয়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউলায় গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের জানিয়েছিলেন, ইসি বিএনপির কাছে পরীক্ষা দিতে চায়। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাধ্যমে ইসি বিএনপির দেয়া প্রতিক্রিয়ার জবাব দিয়েছে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
Leave a Reply